বুধবার ১৫ জানু ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
সারাদেশ

বাউল  আব্দুল  করিমের  ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী

কেবি ১৩ সেপ্টেম্বার ২০২৪ ০৮:৩১ পি.এম

১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী বাউল শাহ্ আবদুল করিম

নিজস্ব প্রতিবেদক : ১২ই সেপ্টেম্বর, বাউল  আব্দুল  করিমের  ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী বিনম্র শ্রদ্ধা বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম।

প্রখ্যাত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-

"মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না...?"

শাহ্ আবদুল করিম বললেন-
"কথা বোঝা গেলেই হইল...
আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই..."

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আশ্চর্য হয়ে বললেন-
"আপনার সৃষ্টি... আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না... এটা কোন কথা... এটার কোন অর্থ আছে...?"

শাহ্ আবদুল করিম বললেন-
"তুমি তো গান গাও...
আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো...

ধর তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে কিন্তু গান শুনতে কোন মানুষ আসে নাই। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে...
গাইতে পারবে...? "
কালীপ্রসাদ কিছুক্ষন ভেবে উত্তর দিলেন-
"না... পারবো না..."
শাহ্ আবদুল করীম হেসে বললেন-
"আমি পারবো...
কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই। সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক... নাম না থাকুক... সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই... সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি..."

কালীপ্রসাদ ভট্টাচার্য জানতে চাইলেই-
"সেই আদর্শটা কি...?"
শাহ আবদুল করীম আবার হেসে বললেন-
"একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে..."
‘এই পৃথিবী একদিন বাউলের পৃথিবী হয়ে যাবে’। 

এ কথাটা বলেছিলেন শাহ আব্দুল করিম। এবং উনার চোখে যে বিশ্বাস, মানে যুগ যুগ ধরে... আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, আমাদের দেশের কোনো রাষ্ট্রপতি কোনো প্রধানমন্ত্রীর চোখে এই বিশ্বাস নেই।... আমরা অনেক নেতাদের মুখে অনেক কথা শুনি, কিন্তু তারা বিশ্বাসে বলেন না কথাগুলো। তারা বলতে হয় বলে বলেন, নয় নিজের স্বার্থে বলেন, নয় লোককে ভুল বুঝানোর জন্য বলেন।...”
- কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য

একবার সুনামগঞ্জে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার কথা। প্রোগ্রামের শেষের দিকে মাইকে ঘোষণা আসলো, এবারে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের হাতে তুলে দেওয়া হবে তিন লাখ টাকার সম্মাননা চেক।

আব্দুল করিম বার্ধক্যে উপনীত। তিনি বোধহয় কানে ভুল শুনলেন। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তিনি পাশে বসে থাকা তার একমাত্র সন্তান জালালকে বললেন, জালাল ইতা কিতা কয়! তিন হাজার টাকা! এ তো অনেক টাকা! এত টাকা দিয়ে আমি কি করতাম!

আব্দুল করিমকে আস্তে করে জানানো হলো, তিন হাজার নয়, টাকার অংকটা তিন লাখ! শাহ আব্দুল করিম অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি হতভম্ব। তিনি বললেন, তিন লাখ? সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলো নিয়্যা আমরা কিতা করমু? আমরার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড় প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল। বলেই তিনি বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন।

একজন মানুষ কতটা আর নির্লোভ হতে পারেন!

দেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সাথে  সম্পর্কের অবনতি  নিয়ে তিনি বলেন,

' হুমায়ূন সাহেব অত্যন্ত জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আমি তাঁকে শ্রদ্ধাও করি। আমাকেও তিনি শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। একবার তিনি টিভিতে একটি অনুষ্ঠান বানানোর জন্য একজন লোককে আমার কাছে পাঠালেন। প্রচার আমি কোনোসময়ই চাইনি, তখনো তা-ই করেছিলাম। কিন্তু লোকটির চাপাচাপিতে ঢাকা গেলাম। হুমায়ূন সাহেব আমার সাক্ষাত্কার নেওয়ালেন, গান গাওয়ালেন। আমি ফিরে আসার সময় উনি সৌজন্যসাক্ষাত্টুকু পর্যন্ত করলেন না, গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলেন। আমার হাসি পেল। এই টাকার জন্য কি আমি এতদূর ঢাকা ছুটে গিয়েছিলাম? আমি হাওরের বনে-বাদাড়ে বড় হয়েছি, মনটা সে রকমই বড়। টাকা আমার কাছে কিছুই না। এই করিম টাকার ধান্ধা করলে এতদিনে অনেক বড়লোক হতে পারত! কই, কখনো তো টাকার পেছনে ছুটিনি। এ ঘটনাটি আমাকে খুব পীড়া দেয়। পরে অনুষ্ঠানটি প্রচারের তারিখও তিনি আমাকে জানাননি। সে ঘটনাই আমি সাক্ষাত্কারে বলেছিলাম। পরে আর কখনো হুমায়ূন আহমদের কাছে যাইনি। সত্য কথা বলার কারণে যদি সম্পর্কের অবনতি হয়ে থাকে—তাতে তো আমার আর কিছুই করার নাই।'

ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ কাকে বলে বাউল দেখিয়ে গিয়েছেন।

তিনি একবার বলেছিলেন,
'এত সংবর্ধনা, সম্মান দিয়ে আমার কী হবে? সংবর্ধনা বিক্রি করে দিরাই বাজারে এক সের চালও কেনা যায় না। পেটে যদি ভাত না থাকে করিম মেডেল গলায় দিয়ে কী করবে?'

স্পষ্টতায়, স্পর্ধায় কাটিয়েছেন এক বাউল জীবন। 

প্রকৃতি ছিল তার প্রথম শিক্ষক। প্রকৃতিই তাকে নিখাদ সোনা করে গড়ে তুলেছে। পার্থিব জীবনের প্রায় দুই যুগ ধরে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এরপর তিনি ভর্তি হন নাইট স্কুলে। স্বাক্ষরজ্ঞান লাভের পর তিনি তার সহপাঠীদের নিয়ে গাজীর গান, বাউলা গান, ঘাটু গান, পালাগান, সারিগান, মালজোড় গান, কবিগানসহ বিভিন্ন অতি প্রাকৃতজনের গান গাইতেন। সে সময় ভাটি অঞ্চলের হাওরে নাও বাইছ  (নৌকা বাইছ)  হতো তখন করিম তার সহপাঠীদের নিয়ে নাওয়ে উঠে গাইতেন  ‘কোন মেস্তুরী নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়  ঝিল-মিল-ঝিল-মিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও’। এভাবে গানের মধ্য দিয়ে চলে তার বাউলগান চর্চা।

ছিলেন রাখাল বালক। স্কুলে কয়েকদিন মাত্র গিয়েছেন। সারাজীবন দরিদ্রতার সাথে লড়াই করেছেন। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা। তবু গান ছেড়ে যান নি করিম। বরং এইসব প্রতিকূলতা তাকে আরো দৃঢ়চেতা করেছে।

ঈদের নামাজে গেছেন। এক মুরুব্বি তাকে দেখেই বললেন, 'করিম ইসলাম ধ্বংস কইরা ফালাইতাছে। গানবাজনা ইসলামে হারাম, এরপরও সে গান গাইতাছে। এইটার বিহিত করা দরকার'। 

তিনি ইমাম সাহেবকে সামনে রেখে সব মানুষের সামনে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, 'গান গাওয়া ইসলামে হালাল কি না?' ইমাম সাহেব বললেন—'গানের সুরে যদি আল্লাহকেও ডাকে, তাহলেও গুনা হবে'।

ব্যাস, আর যায় কই? ওই মুরুব্বি তাকে জিজ্ঞেস করলেন—গান ছাড়ব কি না?তিনি বললেল—সেটা কখনোই আমি পারব না। উত্তর শুনে ওই মুরুব্বি মানুষটি রেগে গেলেন। তিনি বললেন, 'এত স্পর্ধা, ইমাম সাহেব ও মুরুব্বিদের মুখের ওপর কথা। সেটা মেনে নেওয়া যায় না।' 

এরপর তিনি  বললেন, 'এখন বললাম গান ছেড়ে দেব, পরে ছাড়লাম না। তাই এ ধরনের মিথ্যা কথা আমি বলতে পারব না। নিজে যা বিশ্বাস করি, তা-ই বলেছি। আপনার যদি এ কারণে আমাকে গ্রামে জায়গাও না দেন, তাতেও আমি রাজি। 

এরপর থেকে প্রায় প্রতি শুক্রবারে জুম্মার নামাজের আগে-পরে মসজিদে মুসল্লিরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে—গান-বাজনা করে তিনি নাকি বেশরা কাজ করছেন।

তখন গ্রামের আশপাশে সারারাত ধরে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ওয়াজে দেশের বিশিষ্ট ওয়াজিরা এসে আল্লা-রসুলের নাম না-নিয়ে উনা শ্রাদ্ধ করার কাজে যোগ দিয়েছিল। রাতভর অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করত। শেষে একসময় পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে গ্রাম ছাড়েন।

গানের জন্য তাকে ধর্মজীবীরা একঘরে করেছে, স্ত্রী সরলা আর শিষ্য আকবরের জানাযায় অংশ নেয় নি এলাকাবাসী।

শাহ আবদুল করিম লালনের সুযোগ্য শিষ্য। কেন? কারণ-শাহ্ আবদুল করিম তাঁর স্ত্রীকে মনে করতেন মুর্শিদ। ‘মুর্শিদ’ শব্দটার অর্থ-নেতা (আধ্যাত্মিক অর্থে অবশ্য)। শাহ আবদুল করিমের স্ত্রীর নাম ছিল আবতাবুন্নেছা। করিম আদর করে ডাকতেন: 'সরলা।' 

স্ত্রীকে ‘মুর্শিদ’ মনে করাটা সহজ নয়। অনেক শিক্ষিত আধুনিক পুরুষও এক্ষেত্রে পিছিয়ে। কেন? ঈশ্বর পুরুষ বলেই?। করিম কেন পারলেন? করিম বাউল বলেই পারলেন। বাউল বাংলার ধর্ম- বাংলা মাতৃতান্ত্রিক বলেই।

বাউলের স্ত্রী সরলা মারা যাওয়ার পর গ্রামের ইমাম সাহেব বললেন—'বাউলের স্ত্রীর জানাজা পড়ানোর দরকার নাই।' আবার তার প্রিয় শিষ্য আকবর মারা যাওয়ার পর মসজিদের মাইকে তার মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করেনি। তার দোষ, সে বাউলের সঙ্গে থেকে গানটান গেয়ে নাকি বেশরা ও ইসলাম বিরোধী কাজ করেছে। তাই সে বাউলের মতোই কাফের হয়ে গেছে। তিনি বলেন,'বেতনভোগী ইমামের কথা শুনে আর রাগে-দুঃখে নিজেই আমার বাড়িতে কবর খুঁড়েছি। আকবরের জানাজা পড়িয়ে দাফন করেছি। গ্রামের কেউ কেউ আইছিল, কেউ কেউ আয়ে নাই।'

গ্রামীণ ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলদের আচরণে বাউল আবদুল করিম নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন 'কুলহারা কলঙ্কিনী' বলে। শহরে এসে বাউল আবিষ্কার করেন, এখানকার 'শিক্ষিত' মানুষেরাও তাকে মানুষ ভাবতে পারে না। সেজন্যই হয়ত আবদুল করিমকে গাইতে হয়েছে, 'এ জীবনে দূর হলো না.. বাউল করিমের পেরেশানি!'

'মানুষের' দেওয়া এসব কষ্ট বুকে নিয়ে আজকের এই দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বাউল শাহ আবদুল করিম!

বাড়ির কাছে উজানধল বাজার। চাল আনতে সেখানে গেছেন তিনি। ফিরে এলে চুলো জ্বালাবেন— এ অপেক্ষায় বসে রইলেন গিন্নি। সামান্য সময়ের ব্যাপার এ বাজারসদাই। অথচ ঘণ্টা পেরিয়ে দিন যায়, সপ্তাহ পেরোয়। অবশেষে ১৮ দিন পর খবর পাওয়া গেল তিনি আছেন হবিগঞ্জে। এক ভক্তের বাড়িতে গান করছেন। এমনই খেয়ালি মানুষ ছিলেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম।

শাহ আবদুল করিম শুধুমাত্র বাউল ছিলেন না, তিনি একাধারে গণসংগীত শিল্পীও। সারাজীবন শোষিত বঞ্চিতদের পক্ষে গান লিখেছেন। তাঁর আঘাতের লক্ষ্য ছিলো ভণ্ড রাজনীতিবিদ, শোষক, পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ। ধর্মের অপব্যবহার তো অবশ্যই।

শাহ আবদুল করিমের গানে বৈষ্ণব ধারার মীড়াশ্রয়ী সুরের ঝংকারের সঙ্গে সুফী ধারার গতিপ্রধান ছন্দের সম্মিলন ঘটেছে।

শাহ আব্দুল করিম রচিত পাঁচশতাধিক গানে যেমন সিলেটের ঐতিহ্য ও শিকড়ের সন্ধান মেলে তেমনি বৈষ্ণব-সুফী ধারার সাধন-ভজনের পরিচয়ও পাওয়া যায়। একদিকে বাস্তবজীবনের কঠিন কঠোর পথপরিক্রমা অন্যদিকে জগত-জীবন সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ, সৃষ্টির রহস্য নিয়ে কৌতূহল শাহ আব্দুল করিমকে করে তুলেছে বাউল মরমী।

বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের পূর্বসূরি মরমি সাধকরা তত্ত্বকথা বলে গেছেন। সমাজে সাম্য সৃষ্টির আন্দোলন করেছেন। কিন্তু শাহ আবদুল করিমের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন মাত্রার। দেশের, দশের, জনগণের, সমাজের দুঃখ-দুর্দশার কথা তিনি তাঁর রচনায় উল্লেখ করে ভিন্নধর্মী সংগ্রাম করেছেন।

আবদুল করিমের জীবন সংগ্রাম এবং গানের সাধনা দেখে মনে হয়, এ যেন বিদ্রোহী কবি নজরুলেরই গল্প। নিজের দারিদ্রের কথা গানের মধ্য দিয়ে বলতে গিয়েই শাহ আবদুল করিম লিখেছিলেন, ‘মাঠে থাকি গরু রাখি, ঈদের দিনেও ছুটি নাই, মনের দুঃখ কার কাছে জানাই’।

শাহ আবদুল করিম কাগমারী সম্মেলনে গান করে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের শ্রদ্ধা আদায় করে নেন।

শাহ আবদুল করিম বেড়ে ওঠার সময় লোক সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল পরিবেশ ছিল। শাহ আবদুল করিম ৫৪'র নির্বাচন ৬৯,এর গণ আন্দোলন, ৭১'এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি পর্যায়ে স্বরচিত গনসঙ্গীত পরিবেশন করে জনতাকে দেশ মার্তৃকার টানে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর গণসঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে মাওলানা আবদুল হামিদ থান ভাসানী তাঁর পিটে হাত রেখে বলেছিলেন-বেটা, গানের একাগ্রতা ছাড়িও না, তুমি একদিন গণ মানুষের শিল্পী হবে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণসঙ্গীত শুনে একশ পঁচাশি টাকা দেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১১ টাকা দিয়ে বলেন, তোমার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে।

মুখের বোল কাইড়া নিবে 
রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে 
আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলবো 
প্রয়োজনে রক্ত দেবো
জীবন দিয়ে বাংলা রাখবো
ঢাকায় রক্ত দিছে বাংলা মায়ের সন্তান 
আমরা রাখবো তাদের মান।।
~বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম, 

(গানটি তাৎক্ষণিকভাবে বেধেছিলেন যখন শোনেন ঢাকার রাজপথ ভাষার জন্য রক্তে রঞ্জিত হয়েছে; ১৯৫২'র ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি নেত্রকোনার একটি মঞ্চে গান গাইছিলেন।)

তার লেখা বইগুলো হচ্ছে- ‘আফতাব সঙ্গীত’ (আনু. ১৯৪৮), ‘গণসঙ্গীত’ (আনু. ১৯৫৭), ‘কালনীর ঢেউ’ (১৯৮১), ‘ধলমেলা’ (১৯৯০), ‘ভাটির চিঠি’ (১৯৯৮), ‘কালনীর কূলে’ (২০০১) ও ‘শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্র’ (২০০৯)।

শুধু সুরের মূর্ছনায় সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে তাঁর কাছ থেকে বাহবা কুড়িয়ে নেয়ার লক্ষ্য আর সাধারণ গায়কের মতো ছিল না। তিনি সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি থাকতেন বলেই তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সুখ-দুঃখের সাথে তাঁর গভীর পরিচয় ছিল। তাঁর গানের কথা বা ভাষাগুলো তাই প্রমাণ করে। তাঁর গানের মধ্যে সাধারণ মানুষেরই চাওয়া-পাওয়ার সুরই বেজে উঠেছে।

“কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া
আমি ফুল, বন্ধু ফুলের ভ্রমরা
সখী গো আমি ফুল, বন্ধু ফুলের ভ্রমরা।”

একবার এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন- ‘আমি বেহেস্ত, দোজখ চাই না। জীবিত অবস্থায় আমার ভাটি অঞ্চলের বিপন্ন মানুষের সুখ দেখতে চাই। ওই মানুষগুলোর সুখ যারা কেড়ে নিয়েছে আমার লড়াই তাদের বিরুদ্ধে। একসময় তত্ত্বের সাধনা করতাম, এখন দেখি তত্ব নয়, নিঃস্ব-বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, আর সোনার বাংলা সোনার বাংলা করলে হবে না। লোভী, শোষক, পাপাত্মাদের আঘাত করতে হবে।’

'বসন্ত বাতাসে সইগো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে
সইগো বসন্ত বাতাসে...'
-বাউল শাহ আব্দুল করিম

একবার তিনি রেডিও'র একটা চেক ভাঙ্গাতে গেলেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। আব্দুল করিমের পরনে ছেঁড়া পাঞ্জাবি। তাকে দেখে ব্যাংকের কেউ কি ভেবেছে কে জানে! কিন্তু আব্দুল করিম ভীষণ অপমানিত বোধ করেছেন। তিনি বিলাতে গান গাইতে গিয়েছেন। সেখানে দেখেছেন, মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু নিজের দেশে দেখলেন এখানে মানুষের মর্যাদা পদ পদবিতে, পোষাকে, চেহারায়। 

সাক্ষাৎকারে তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন,
আমার পাঞ্জাবি ছেঁড়া তো কি হয়েছে, আমি কি এই দেশের নাগরিক না? আমার লুঙ্গিতে নাহয় তিনটা তালি বসানো, কিন্তু আমি তো ট্যাক্স ফাঁকি দেই নাই কখনো। তাহলে এত ব্যবধান, এত বৈষম্য কেন? মানুষ তো মানুষের কাছে যায়। আমি তো কোনো বন্যপশু যাইনি। বন্যপশুরও অনেক দাম আছে, এদেশে মানুষের কোনো দাম নেই, ইজ্জত নেই।

বসন্তে জন্মছিলেন বলেই হয়ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মাটির গন্ধ গলায় তুলে নিয়েছিলেন বাউল শাহ আব্দুল করিম।লাল সবুজের সুরের ডাক নাম শাহ আব্দুল করিম।

শাহ আবদুল করিমের ভাটির সুরের গান শুনে মনের তলায় জল ছলছল করে। বাঙালি মন লোকসুরের জাদুতে যত ভোলে, আর কিছুতে ততটা মজে বলে মনে হয় না। মায়ার টান খুব শক্তিশালী, যেমন তিনি লিখেছেন, ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে’! 

এই মায়ার টানে তিনি কোনোদিন কালনি নদী ছেড়ে যাননি। মায়ার টানে পড়েই গ্রামীণ মানুষের সুখ–দুঃখ, প্রেম–ভালাবাসার ব্যালাড রচনা করে গেছেন। 

গ্রিক নন্দনের শক্তি যেমন ট্র্যাজিক চেতনা, বাংলা সংস্কৃতির মর্মে তেমন পাই মায়া। মানুষের প্রতি মায়া, ছেড়ে আসা গ্রামের প্রতি মায়া, প্রকৃতির প্রতি মায়া—এমন হাজারো মায়ার টানে ভোগা মানুষ জানে, মায়ার বন্ধন কত শক্তিশালী। মৃত্যু ছাড়া তার বন্ধন নাকি ছেঁড়া যায় না।

শাহ আবদুল করিমের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম ছেঁকে নিলে যা পাই, তা এই মায়া। মায়া বাংলাদেশের কৃষক সংস্কৃতির মূল রস। এটা আমাদের আধুনিক সাহিত্যেও ছড়িয়ে গেছে। 

একজন স্বশিক্ষিত কবি। তার চেতনাই তার সৃজনের জ্ঞানশিক্ষা। বাংলার মাটি, জল, সবুজ, সুন্দরমা প্রকৃতিই তাঁর পাঠশালা। সেই পাঠশালার চিত্রছায়ায় পাঠ নিতে নিতে তিনি অনুধাবন করেছেন জীবনকে, জীবনের একক নিয়ামক শক্তিকে।তাইতো তিনি অকপটে  বলতে পারেন, ‘কেউ বলে দুনিয়া দোজখ, কেউ বলে রঙের বাজার / কোনো কিছু বলতে চায় না, যে বুঝেছে সারাসার।’

তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার বোধহয় মানুষের ভালোবাসা। শাহ আবদুল করিমের গান মানুষের মুখে মুখে। আরও হাজার বছর বেঁচে থাকবে তার গান। তার গান গেয়ে অনেক শিল্পী জনপ্রিয় হয়েছেন। ভবিষ্যতেও হবে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বহুল চর্চা হচ্ছে তার গান। একজন সুর সাধকের জন্য এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে!!

শেষ বয়সে এসে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্ট, কিডনির জটিলতা, ফুসফুসে ইনফেকশন এবং বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। 

চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ই ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে উজান ধল গ্রামে স্ত্রী সরলা বিবির কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। 

এই সম্পর্কিত আরও খবর

আরও খবর

news image

চট্টগ্রামে ৬ অবৈধ ভবন উচ্ছেদ, সাড়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা

news image

তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, শীতের তীব্রতা কিছুটা কমেছে

news image

লালমনিরহাটে রেলের জমি দখলমুক্ত, অবৈধ মার্কেট উচ্ছেদ

news image

ক্ষমতাধরদের জবাবদিহির এখনই আদর্শ সময়: প্রেস সচিব

news image

পীরগঞ্জের কবি কাজী হায়াত মামুদের সমাধীস্থল ও ওয়াকফ এষ্টেট নিয়ে বিরোধ

news image

"ছাত্রলীগ ভয়ংকর রূপে ফিরবে" বার্তায় উত্তেজনা, তদন্তে প্রশাসন

news image

যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছার লাউজানী রেলক্রসিং মরণফাঁদ 

news image

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী 

news image

গাজীপুর কারাগারে শেখ জহিরুল ইসলামের অকাল প্রয়াণ

news image

গৌরীপুরে কয়লা ট্রাকে চাঁদাবাজি: যৌথবাহিনীর অভিযানে তিনজন গ্রেপ্তার

news image

টেকনাফে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপনে ছাড়া পেলেন অপহৃত জসিম

news image

চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রার রেকর্ড পতন, শীতের কষ্টে ছিন্নমূল মানুষ

news image

সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকসহ ৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি

news image

৩ দিন গ্যাসের স্বল্পচাপ থাকবে : পেট্রোবাংলা

news image

পঞ্চগড়ে হিমেল বাতাসে বিপর্যস্ত জনজীবন

news image

বিএনপির বাধায় উত্তেজনা, পুলিশের লাঠিচার্জে আহত ১০ জন

news image

গফরগাঁও সরকারি কলেজে দিনব্যাপী বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত 

news image

আসছে একাধিক শৈত্যপ্রবাহ

news image

খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় জি এম কাদেরের শুভেচ্ছা বার্তা

news image

গণহত্যা ও গুমের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৯৭ জনের পাসপোর্ট বাতিল

news image

সচিবালয় গেটে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ, ২ রাউন্ড ফাকা গুলি

news image

১৬ ঘণ্টা আটকে মালয়েশিয়া থেকে ফেরা বাংলাদেশিরা, সেবার অভাবের অভিযোগ

news image

শিবালয়ে শিক্ষানবিশ আইনজীবীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

news image

ব্র্যাক ব্যাংক চকরিয়া শাখার ভল্ট থেকে ৮২ লাখ টাকা গায়েব

news image

সিইউজে নির্বাহী কমিটির নির্বাচন ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে

news image

ঢাকার বায়ুর মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’, স্কোর ২৬৬

news image

ঈশ্বরগঞ্জে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ৪ নেতা গ্রেপ্তার

news image

লক্ষ্মীপুরে ছাত্র হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার

news image

ট্রাফিক আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে ডিএমপির অভিযানে ১,৯৭৫ মামলা

news image

রাজবাড়ীতে সেনাবাহিনীর আধুনিক সামরিক প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করলেন প্রধান উপদেষ্টা